সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়ের আকার বেশি দেখানো হচ্ছে

0

সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় মূলত চরম দরিদ্র, অক্ষম কিংবা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমন ব্যক্তি বা পরিবারকেই সহায়তা করা হয়। খাতটির সুবিধাভোগী নির্বাচনে এটাই বৈশ্বিক চর্চা। বাংলাদেশেও এ ধরনের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে এসেছে সরকার। বয়স্কদের জন্য চালু রয়েছে বয়স্ক ভাতা। ভাতা পাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও দুস্থ নারীরাও। ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য রয়েছে ভিজিডি-ভিজিএফ কর্মসূচি।

এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে গত এক দশকে সরকারের বরাদ্দ বেড়েছে কয়েক গুণ। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশই বরাদ্দ রাখা হয় সামাজিক নিরাপত্তা খাতের জন্য, যার পরিমাণ ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা।

তবে অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যে বিশাল বরাদ্দ রয়েছে তার বড় একটি অংশই যাচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারিদের পেনশনের পেছনে। প্রজাতন্ত্রের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পেনশন সুবিধা দেয়াটা রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়লেও এ দায় দরিদ্রদের জন্য নেয়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমেই সারছে সরকার। পেনশনে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বরাদ্দ রাখার মাধ্যমে বড় করে দেখানো হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মোট ব্যয়। পেনশনের মতো বিষয়গুলো আওতায় আনার মধ্য দিয়ে পুরো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকেই ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে প্রকৃত উপকারভোগীর সঠিক চিত্র উঠে আসছে না, যা সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দ ছিল ৬৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। সেখানে সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পেনশনের জন্য রাখা হয়েছে ২২ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার জন্য প্রতি মাসে বরাদ্দ ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা।

অন্যদিকে একই অর্থবছরে প্রায় ৪০ লাখ বয়স্ক মানুষের জন্য বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রতি মাসে বরাদ্দ ছিল ২০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে একজনের জন্য প্রতি মাসে বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ৫০০ টাকা। এভাবেই বৈষম্যমূলক ও প্রশ্নবিদ্ধ বরাদ্দ রাখার মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মোট ব্যয়কে বড় করে দেখানো হচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে পেনশনের অর্থ অন্তর্ভুক্তি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নীতিনির্ধারক মহল এটি নিয়ে বিকল্প চিন্তা ও কৌশল তৈরি করছে বলে জানতে পেরেছি। সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। যে ব্যয়টি করা হচ্ছে সেটির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি কর্মসূচিগুলোর মধ্যে আরো টিউনিং করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে বেশকিছু কর্মসূচিকে আরো একীভূত করতে হবে। গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য অর্থায়ন প্রক্রিয়া আরো কীভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ প্রয়োজন। সেটি অবশ্যই গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য দেয়া কর্মসূচির মতো হলে হবে না। সেখানে নতুন ইনোভেশন প্রয়োজন।

জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের (এসএসএনপিএস) আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৮৯ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দ ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ২১ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং বাজেটের ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো বরাদ্দকৃত অর্থের এক-তৃতীয়াংশই ছিল পেনশনভোগীদের জন্য। ফলে প্রকৃত অর্থে দরিদ্র কিংবা পিছিয়ে পড়াদের কাছে কতটুকু অর্থ যাচ্ছে সেটি পরিষ্কার নয়। আবার সব ধরনের দরিদ্র মানুষের কাছে কর্মসূচির অর্থ পৌঁছাচ্ছেও না। এসব কারণে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেটি প্রকৃতপক্ষে বেশ কম হবে বলে মনে করছেন সংশিশ্লষ্টরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ কিংবা স্টিমুলাস প্যাকেজের সুদ পরিশোধ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করে মোট ব্যয়কে বেশি দেখানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এমন অনেক ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাহলে স্বল্প সুদে ঋণ কিংবা কৃষিঋণের সুদ কেন বাকি থাকবে?

উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ব্যয় আলাদা করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে গরিব ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের কাছে কতটুকু যাচ্ছে সেটি পরিমাপ করতে হবে। এ খাতের ব্যয়ে সুশাসন ও যৌক্তিকতা আনতে উদ্যোগ নিতে হবে। যৌক্তিকভাবে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি যাদের পাওয়ার কথা তাদের কাছে সহায়তা আরো দ্রুত পৌঁছাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সুবিধাভোগী মানুষকে হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, বরাদ্দকৃত অর্থ বিতরণের ক্ষেত্রে পরিচালন দক্ষতা আনতে হবে। সেখানে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করা এবং সঠিক তথ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এছাড়া সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আরো দ্রুত সমন্বয় আনতে হবে। বেশকিছু কর্মসূচিকে একীভূত করতে হবে।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষের কাছে ন্যায্যমূল্যে কিছু পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৮৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। অন্যদিকে সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৪২৫ কোটি টাকা। মূলত দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যয়ের জন্য এসব অর্থ দেয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটির দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে এ অর্থ সুবিধাভোগীরা পাচ্ছে কিনা সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

আবার শিক্ষা খাতের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থকেও সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্কুলে ধরে রাখতে যে ‘স্কুল ফিডিং প্রোগাম’ রয়েছে সেটিও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গৃহীত কর্মসূচি রয়েছে এর আওতায়। এসব কর্মসূচি কোনোভাবেই সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে যায় না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

আবার এমন অনেক খাত রয়েছে যেখানে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বেশ কম। ১০ লাখ প্রতিবন্ধীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪০ কোটি টাকা। প্রতি মাসে এসব প্রতিবন্ধীর জন্য বরাদ্দ হয় মাত্র ৭০০ টাকা। ফলে যাদের প্রয়োজন তাদের কম বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে সার্বিক কার্যক্রমে এক ধরনের বৈষম্যমূলক পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ বা প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। কিন্তু সরকারের হিসাবেই প্রায় এক কোটি মানুষের কাছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা পৌঁছানো হলেও উপেক্ষিত থাকছে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, কল্যাণমূলক ও নাগরিকের সুরক্ষার জন্য ব্যয় অবশ্যই সামাজিক নিরাপত্তা খাতে তাত্ত্বিকভাবে হিসাবে নিতে পারে রাষ্ট্র। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেই প্রচলন রয়েছে। তবে দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে ভিন্নভাবে দেখতে হলে, কার্যকারিতার মূল্যায়ন করতে হলে ব্যয়ের শ্রেণিবিন্যাস করা প্রয়োজন রয়েছে। কারণ পেনশনের বাইরে দরিদ্র মানুষ কতটুকু পাচ্ছে সেটি বিশ্লেষণ করতে হবে। যার প্রাপ্য সে পাচ্ছে কিনা এবং যতটুকু দেয়া হচ্ছে ততটুকু পৌঁছাচ্ছে কিনা তাও মূল্যায়ন করতে হবে। এসব কার্যক্রম ও উদ্যোগে সরকার বেশ আন্তরিক। কারণ ১৯৯৬ সালে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে বর্তমান সরকার। ২০১৫ সালে গ্রহণ করেছে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র। ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের দরিদ্র মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সব মানুষকে অন্তর্ভুক্তকরণ ও সার্বিক কার্যক্রমে দক্ষতা আনতে সরকার পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেও জানান তিনি।

উত্তর দিন