শেখ হাসিনা সরকারের কেনা ইসরাইলি নজরদারি সরঞ্জাম ব্যবহার করে কোনো কোনো বিদেশী এজেন্সি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আড়ি পেতে নিয়ে গেছে বলে চাঞ্চল্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি সরকারের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো খতিয়ে দেখছে বলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে একের পর এক তথ্য ফাঁস, নজরদারির অভিযোগ এবং বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সম্ভাব্য কার্যক্রম নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় গোয়েন্দা মূল্যায়ন সেলের একটি অভ্যন্তরীণ ব্রিফিং থেকে শুরু করে টেলিকম সেক্টরের সাইবার মনিটরিং ডেটা- সব কিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দেশের নিরাপত্তা পরিমণ্ডল এখন একটি সংবেদনশীল ক্রস-রোডে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন উঠছে- আড়ি পাতা কি নিরাপত্তার প্রয়োজনে বৈধ সহযোগিতা, নাকি এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষয়ের আরেকটি অধ্যায়?
বাংলাদেশে নাগরিক নজরদারি- বরাবরই বিতর্কিত ছিল। তবে বিগত সরকার আমলে গোপনে সংগৃহীত আড়ি পাতার যন্ত্রপাতি, এর উৎস, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগী চক্র এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ‘গোপন ব্যবহারে’ কী পরিমাণ প্রযুক্তি ও টাকা খরচ হয়েছে- তা নিয়ে এখন যে তথ্য বেরিয়ে আসছে, সেটি কেবল একটি নীতি বিতর্ক নয়; বরং বাংলাদেশে বিদেশী গোয়েন্দা প্রযুক্তির নীরব অনুপ্রবেশ ও জাতীয় নিরাপত্তা খাতের গোপন বাণিজ্যিকীকরণের ভয়াবহ চিত্র।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সাম্প্রতিক বৈঠকের পর প্রেস সচিব শফিকুল আলম যেভাবে বললেন- ‘অনেক কিছুই ইসরাইল থেকে কেনা হয়েছে’ এটি কেবল একটি বাক্য নয়; বরং এক দশকব্যাপী একটি অন্ধকার নেটওয়ার্কের প্রথম সরকারি স্বীকারোক্তি।
এরই মধ্যে সরকারিভাবে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। কমিটির প্রধান হলেন- প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তারাই খতিয়ে দেখবেন কোন সংস্থা কত টাকায় কোন প্রযুক্তি কিনেছে, দালাল বা মধ্যস্থতাকারী কারা, সরকারি অনুমোদন ছিল কী না, যন্ত্রগুলো ব্যবহার হয়েছে নাগরিকের বিরুদ্ধে, নাকি অন্য উদ্দেশ্যে এবং এই প্রযুক্তি নাগরিকের ডেটা কোথায় পাঠিয়েছে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- কেন বাংলাদেশ গোপনে ইসরাইলি নিরাপত্তা প্রযুক্তি কিনল, যখন দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। এই সিদ্ধান্ত কি রাজনৈতিক? নাকি গোয়েন্দা সংস্থার ভেতরের কোনো স্বার্থচক্রের অংশ?
প্রেস সচিবের ভাষ্যমতে, দুই ধরনের রিপোর্ট রয়েছে : ২০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্য আর ৩০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্য। অর্থাৎ ২১০০ থেকে ৩২০০ কোটি টাকার একটি ছায়া-বাজেট গিয়েছিল আড়ি পাতা, স্পাইওয়্যার, ট্র্যাকিং ভ্যান, ডেটা ইন্টারসেপশন ডিভাইস, ডিপ-প্যাকেট ইন্সপেকশন সিস্টেম ও সাইবার নজরদারি সফটওয়্যার কেনায়।
এখন পর্যন্ত পাওয়া নথি বলছে- এই অর্থের বড় একটি অংশ গিয়েছে: ১. সাইপ্রাস-ভিত্তিক প্যাসিটোরা (আগে উইস্পিয়ার), ২. সুইজারল্যান্ডের তরু গ্রুপ, ৩. ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান সেলেব্রাইট ও ৪. ইসলামী ডিফেন্স ফোর্স আইডিএফ-এর সাবেক গোয়েন্দাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান-পিকসিক্স এ।
এই বাজারের সাথে যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশী দালাল, বিদেশে অবস্থানরত মধ্যস্বত্বভোগী, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থার কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা এবং মন্ত্রণালয়/ক্রয় কমিটির কিছু রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
তদন্তকারীরা বলেছেন- এই বাজারে ওঠানামা করেছে অবৈধ কমিশন, বিদেশী সফর, ব্যক্তিগত চুক্তি, এবং টেন্ডারের বাইরে ‘বিশেষ অনুমোদনে’ ক্রয়।