ভ্যাকসিন আসার পরও থাকছে চ্যালেঞ্জ

0

জার্মান শহর মেইঞ্জ এখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে নভেল করোনাভাইরাসের একটি ভ্যাকসিনকে কেন্দ্র করে। এ ভ্যাকসিনকে ডাকা হচ্ছে বিএনটি১৬২বি২ নামে। এটি হচ্ছে ‘নিউক্লিসাইড-মোডিফাইড ম্যাসেঞ্জার আরএনএ’, যা উন্মোচিত করে সার্স-কোভ-২-এর পূর্ণ দৈর্ঘ্যের স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিনকে।

অন্য কথায় বললে, এটি সম্ভবত বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রথম বৈধ ভ্যাকসিন হতে যাচ্ছে। এটি বিকশিত হয়েছে প্রফেসর ড. উগার সাহিন এবং তার স্ত্রী ড. ওলেম টুরেসির নেতৃত্বে। দুজনই তুর্কি অভিবাসীর সন্তান। সাধারণ সময়ে যা বেশ উৎসাহজনক গল্প হতে পারত। যদিও বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ আখ্যানটি খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না, যেখানে বিশ্বব্যাপী প্রতিদিনকার সংক্রমণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি সবার ভাবনা, কীভাবে আমরা দ্বিতীয় ঝড়কে থামাব? ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই কি শিগগিরই শেষ হবে? কখন আমরা ভাইরাসকে হারাতে পারব?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য এরই মধ্যে করোনার বিরুদ্ধে বিজয় দিবস শনাক্ত করে ফেলেছেন! সেপ্টেম্বরে তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, এপ্রিলের মধ্যে সব আমেরিকানের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিন থাকবে। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ না।

বর্তমান সময়ে সাংবাদিকরা যদি সাহিনের সঙ্গে কথা বলতে চান, তবে বাধ্যতামূলকভাবে এফএফপি২ মাস্ক পরতে হবে এবং বিল্ডিংয়ের কোন জায়গায় তার অফিস সেটি উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি নিরাপত্তার জন্য পেশিবহুল রক্ষীদের একটি দলকে নিয়োগ করা হয়েছে এবং ঘরোয়া নিরাপত্তা এজেন্টরাও ল্যাবরেটরিকে ভার্চুয়াল আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে যা করা সম্ভব তা করছেন। লক্ষ্য যতই এগিয়ে আসতে শুরু করেছে, ঝুঁকিও অনেক বেড়েছে। এরই মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে প্রথম কার্যকর ভ্যাকসিন খুব শিগগিরই প্রস্তুত হবে।

সাহিনসহ বায়োনটেকের আরো ৫০০-এর বেশি বিজ্ঞানী এখন উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠা নিয়ে ৪৪ হাজার অংশগ্রহণকারীর ওপর প্রয়োগ করা ভ্যাকসিনের ফলের অপেক্ষায় আছেন। এ অংশগ্রহণকারীরা হয় বিএনটি১৬২বি২ কিংবা প্লাসেবো গ্রহণ করেছেন। যদি ফল উৎসাহজনকভাবে ইতিবাচক হয়, তখন কোম্পানিটি জরুরি অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে পারবে। এর অর্থ হচ্ছে ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে।

যদিও এখনো কয়েক সপ্তাহের জন্য বিলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেটি হতে পারে ডাটা অপর্যাপ্ত হলে কিংবা রেগুলেটরি কমিটির আরো সময় প্রয়োজন হলে। অথবা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভ্যাকসিন যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না করে।

বিশ্বব্যাপী এখন ৪৮টি ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। যাদের ১১টিই আছে শেষ ধাপে। গবেষকরা একমত যে অনেকগুলো ভ্যাকসিন হয়তো পাওয়া যাবে। সেজন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষাও করতে হবে না। যদিও মূল প্রশ্নটি এখানে অন্য: এর মধ্য দিয়েই কি আমাদের মহামারী থেকে মুক্তির অপেক্ষা শেষ হবে? সবকিছু কি আবারো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে? নাকি মৃত্যু এবং সংক্রমণের ভার কিছুটা কমিয়ে নাটকীয়তা আরো দীর্ঘায়িত হবে, যে কারণে আরো দুই বছর আমাদের মাস্ক পরতে হবে এবং সামাজিক দূরত্বের নীতি মেনে চলতে হবে?

এর আগে কখনই গোটা মানবজাতি এভাবে একসঙ্গে চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রতিকারের দিকে মনোযোগ দেয়নি। এত অল্প সময়ের মধ্যে সেরামের ওপর এর আগে কখনই এত অর্থ বিনিয়োগ করা হয়নি। এমনকি এর আগে কখনই বিজ্ঞানী, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এবং রাজনীতিবিদরা ভ্যাকসিন বিতরণের জন্য এতটা চাপের মুখে পড়েননি।

এসব কিছু একটি অর্জনের দিকে চালিত করেছে, খুব শুরুতে অল্প মানুষই যা সম্ভব মনে করেছে: ৮ থেকে ১০ বছরের পরিবর্তে মাত্র এক বছরের মধ্যে একটি নতুন ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা। এটা অবিশ্বাস্য এক অর্জন, কিন্তু তার পরও আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কারণ ভ্যাকসিন শেষ পর্যন্ত এমন কোনো কিছু না, যা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহামারীর অবসান ঘটবে।

খুব সম্ভবত শুরুতে এটি মাঝারিভাবে কার্যকর হবে, যা প্রাথমিকভাবে কভিড-১৯-এর উপসর্গ আরো খারাপ হওয়া থেকে রক্ষা করবে, কিন্তু সংক্রমণের আশঙ্কা পুরোপুরিভাবে দূর করবে না। এটাও এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না যে, কতটা সময় পর্যন্ত ভ্যাকসিন আমাদের সুরক্ষা প্রদান করবে। ছয় মাস? এক বছর? তাই তাত্ক্ষণিকভাবে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তবে প্রথম ভ্যাকসিনটি অনুমোদন পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেখানে আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি থাকবে। ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ? ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর? কতটি ডোজ উপলব্ধ এবং সবার আগে কাকে ভ্যাকসিন দিতে হবে? কীভাবে আপনি গোটা দেশকে ভ্যাকসিন দিতে পারবেন?

গত কিছু সপ্তাহ ধরে ডার স্পিগেল অবশ্য এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে। যদিও এ দিনগুলো অনেকটা সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো। কেবল তা-ই নয় এই লড়াই দ্বিতীয় ঝড়, প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাওয়া লাখো সংক্রমণ এবং বাড়তে থাকা মৃতের সংখ্যার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাহিন বলেন, প্রতিটি সপ্তাহ হিসাব করতে হয়। যদিও তাদের বিকাশমান ভ্যাকসিন কার্যকর হবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। যদি না হয়, তবে সব নষ্ট করে ফেলতে হবে।

এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া, এমনকি বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির জন্যও। জার্মান সরকারের অর্থায়ন থাকার পরও বড় ঝুঁকিতে আছে বায়োনটেকের মতো ছোট কোম্পানিও। তবে বায়োনটেক যে গতিতে এগিয়েছে তা কোম্পানির নিজেদের বিজ্ঞানীদেরও শুরুতে বিস্মিত করেছিল। মূলত কয়েক দশকের অভ্যাস ও নিষ্ঠার কারণে নিজেদের লক্ষ্যে দ্রুতই এগিয়ে যেতে পেরেছিল তারা। এর মাঝে অবশ্য নানামুখী রাজনৈতিক জটিলতাও দেখা দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত এখন আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায় আছে ভ্যাকসিনটি। অবশ্য এখনো বাধা শেষ হয়ে যায়নি। ভ্যাকসিন আসলেই কতটা ভালো তা জানতে হয়তো কয়েক মাস, এমনকি বছরও লেগে যেতে পারে। যদিও সাহিন আশাবাদী। তবে তিনি দুটি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন যা ভ্যাকসিনকে জিতে আসতে হবে। একটি হচ্ছে, অসুস্থতাকে রোধ করা এবং অন্যটি হচ্ছে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা। যদি এ দুটি করতে পারে, তবে সেটাই হবে বিশাল সাফল্য। কারণ, এটুকু করতে পারলেই মহামারীর লাগাম টেনে ধরা যাবে। নিজেদের ভ্যাকসিনের ব্যাপারে সাহিন অবশ্য আশাবাদী। যদিও খুব কম বিশেষজ্ঞই সাহিনের মতো আশাবাদী। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্যাকসিন গ্রহণকারী মানুষও ভাইরাস ছড়াতে পারেন। তাতে অবশ্য দ্রুত সেরে ওঠার সুযোগ থাকে এবং অপেক্ষাকৃত কম মানুষ সংক্রমিত হবে। এটাও মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহযোগিতা করবে। তবে সেক্ষেত্রে মহামারী আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

উত্তর দিন